রক্ত কি? রক্ত কাকে বলে? রক্তের প্রকারভেদ ও কাজ সম্পর্কে বিস্তারিত

জীবনীশক্তির মূল হচ্ছে রক্ত। রক্তনালির ভেতর দিয়ে সারা দেহে রক্ত প্রবাহিত হয়। রক্ত কোষে অক্সিজেন ও খাদ্য উপাদান সরবরাহ করে। আর এ কারণেই দেহের সব কোষ সজীব এবং সক্রিয় থাকে। তাই আমাদের জন্য রক্তের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। চলুন তাহলে রক্ত কি এবং রক্তের প্রকারভেদ ও কাজ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেই –

রক্ত কি? কাকে বলে?

রক্ত হলো একটি অস্বচ্ছ, মৃদু ক্ষারীয় এবং লবণাক্ত তরল পদার্থ। একে তরল যোজক কলাও বলা হয়। যা হৃদপিণ্ড, শিরা, উপশিরা, ধমনী এবং কৌশিকনালী পথে আবর্তিত হয়।

প্রাণীদেহে রক্ত সংবহন

প্রাণীদেহে সংবহনতন্ত্র দু ধরণের। যথাঃ

  • রক্ত সংবহনতন্ত্র
  • লসিকা সংবহনতন্ত্র

রক্ত সংবহনতন্ত্র

যে তত্ত্বের মাধ্যমে, রক্ত সব সময় দেহের বিভিন্ন অঙ্গ ও অংশে চলাচল করে, তাকে রক্ত সংবহনতন্ত্র বলে। আর এই তন্ত্রে প্রবাহিত রক্তের মাধ্যমেই খাদ্য, অক্সিজেন এবং রক্তের বর্জ্য পদার্থ দেহের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় প্রবাহিত হয়।

রক্ত সংবহনতন্ত্রের তন্ত্রের উপাদান

রক্ত সংবহনতন্ত্রের উপাদানগুলো হল –

  • হৃদপিণ্ড
  • ধমনী
  • শিরা ও জালিকা
  • কৈশিকনালী ইত্যাদি

রক্ত সংবহন তন্ত্রের প্রকারভেদ

রক্ত সংবহনতন্ত্র দুই প্রকার। যথাঃ

  • মুক্ত সংবহনতন্ত্র
  • বদ্ধ সংবহনতন্ত্র

মুক্ত সংবহনতন্ত্র

যে সংবহনতন্ত্রের মাধ্যমে রক্ত শুধুমাত্র রক্ত প্রবাহের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে দেহ গহ্বর বা সেলম নামে ফাঁকা স্থানে মুক্ত হয়ে থাকে, তাকে মুক্ত সংবহনতন্ত্র বলে। যেমন – চিংড়ি মাছের সংবহনতন্ত্র।

মুক্ত সংবহনতন্ত্রের সুবিধা

মুক্ত সংবহনতন্ত্রের কয়েকটি সুবিধা হল –

  • এরকম সংবহনতন্ত্রে রক্ত দেখা গহব্বরে উন্মুক্ত হয়
  • অমেরুদন্ডী প্রাণীদের দেহে এরকম সংবহনতন্ত্র দেখা যায়
  • রক্তকণা কোষের প্রত্যেক্ষ সংস্পর্শে আসে
  • সংবহনতন্ত্রে জালক থাকেনা তবে হিমসিল ও সাইনাস থাকে।
  • হৃদপিণ্ড অনুন্নত ও সরল প্রকৃতির ইত্যাদি।

বদ্ধ সংবহনতন্ত্র

যে রক্তপ্রবাহ শুধুমাত্র হৃদপিণ্ড এবং রক্তনালীগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, কখনো এর বাইরে আসে না তাকে বদ্ধ সংবহনতন্ত্র হলে। যেমন – মানবদেহের রক্ত সংবহনতন্ত্র।

বদ্ধ সংবহনতন্ত্রের সুবিধা

বদ্ধ সংবহনতন্ত্রের কয়েকটি সুবিধা হল –

  • এ রক্ত সংবহন তন্ত্রের মাধ্যমে সারা দেহে রক্ত একবার সম্পূর্ণ ভ্রমণের জন্য মাত্র 1 মিনিট বা তার চেয়ে কম সময় লাগে।
  • রক্ত সরাসরি দেহের বিভিন্ন অঙ্গে পৌঁছে
  • রক্ত বিভিন্ন অঙ্গের ভ্রমণ করে দ্রুত হৃদপিন্ডের ফিরে আসে ইত্যাদি।

রক্ত লাল হয় কেন?

রক্তের তিন ধরনের কণিকার মধ্যে লোহিত রক্তকণিকায় হিমোগ্লোবিন নামক রঞ্জক পদার্থ থাকার কারণে রক্তের রং লাল দেখায়। তাছাড়া হাড়ের লাল অস্থিমজ্জাতে রক্তকণিকার জন্ম হয়।

রক্তের উপাদান

রক্ত এক ধরনের তরল যোজক কলা। রক্তের উপাদান দুইটি।যথাঃ

  • রক্তরস
  • রক্ত কণিকা

রক্তরস

রক্তের বর্ণহীন তরল অংশকে বলা হয় রক্তরস। রক্তের শতকরা ৫৫% রক্তরস। এর প্রধান উপাদান পানি। তাছাড়াও বাকি অংশে কিছু প্রোটিন, জৈব যৌগ, অসামান্য অজৈব লবণ দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে। এর মধ্যে যেসব পদার্থ থাকে তা হল –

  • প্রোটিন
  • গ্লুকোজ
  • ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চর্বি কণা
  • খনিজ লবণ
  • ভিটামিন
  • হরমোন
  • এন্টিবডি
  • বর্জ্য পদার্থ ইত্যাদি।

এছাড়াও সামান্য সোডিয়াম ক্লোরাইড, সোডিয়াম বাই কার্বনেট ও অ্যামাইনো এসিড থাকে । আমরা যে খাবার খাই, তা পরিপাক হয় অন্ত্রের গোত্রে শোষিত হয় এবং রক্ত মিশে মিশে সারা দেহে সঞ্চালিত হয়।

রক্তকণিকা

রক্তের প্লাজমার মধ্যে নির্দিষ্ট আকার ও গঠন বৈশিষ্ট্য উপাদানসমূহ বা রক্ত কোষসমূহকে রক্তকণিকা বলে। এককথায় রক্তের কোষগুলোকে রক্তকণিকা বলে।

রক্ত কণিকার প্রকারভেদ

রক্তকণিকা তিন প্রকার।যথাঃ

  • লোহিত রক্তকণিকা
  • শ্বেত রক্তকণিকা
  • অনুচক্রিকা

লোহিত রক্তকণিকা

তিন ধরনের রক্ত কণিকার মধ্যে লোহিত রক্ত কণিকার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। লাল অস্থিমজ্জায় লোহিত রক্ত কণিকা সৃষ্টি হয়। মানুষের লোহিত রক্ত কণিকায় নিউক্লিয়াস থাকে না এবং দেখতে অনেকটা দ্বি অবতল বৃত্তের মত। এর গড় আয়ু 120 দিন।

একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির রক্তের লোহিত রক্ত কণিকার সংখ্যা প্রতি কিউবিক মিলিমিটারে প্রায় 50 লক্ষ। যা শ্বেত রক্তকণিকার চেয়ে প্রায় ৫০০ গুণ বেশি। পুরুষের তুলনায় মহিলাদের রক্তে লোহিত রক্তকণিকা কম। তবে শিশুদের দেহে লোহিত রক্ত কণিকার পরিমাণ বেশি থাকে। আমাদের জীবনের প্রতি মুহূর্তে লোহিত রক্ত কণিকা ধ্বংস হয়, আবার সম পরিমাণে তৈরিও হয়।

লোহিত রক্ত কণিকার কাজ

  • লোহিত রক্তকণিকা অক্সিহিমোগ্লোবিন রূপে অক্সিজেন এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড পরিবহন করে
  • কোষে খাদ্যসার পরিবহন করে
  • রক্তের সান্দ্রতা রক্ষা করে
  • এটি রক্তের অম্ল-ক্ষারত্ব ও আয়রনের ভারসাম্য বজায় রাখে।
  • এর গায়ে উপস্থিত নানা ধরনের এন্টিজেন দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বজায় রাখে
  • দেহের বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশনে কাজ করে।

শ্বেত রক্তকণিকা বা লিউকোসাইট

লোহিত রক্তকণিকা তুলনায় শ্বেত রক্তকণিকা অনেক কম। এর নির্দিষ্ট কোন আকার নেই। এটি হিমোগ্লোবিনবিহীন এবং নিউক্লিয়াস যুক্ত বড় আকারের কোষ। আর হিমোগ্লোবিন না থাকার কারণে এদেরকে শ্বেত রক্তকণিকা বলা হয়। ইংরেজিতে White Blood Cell বা WBC বলে। এরা রক্তরসের মধ্য দিয়ে নিজেরাই চলাফেরা করতে পারে।

এর গড় আয়ু 1 থেকে 15 দিন। এরা অ্যামিবার মত দেহের আকার পরিবর্তন করতে পারে। মানব দেহের প্রতি ঘন মিলিমিটার রক্তে 4 থেকে 10 হাজার শ্বেত রক্ত কণিকা থাকে। অসুস্থ মানবদেহে এর সংখ্যা বেড়ে যায়।

শ্বেত রক্ত কণিকার প্রকারভেদ

গঠনগতভাবে এবং সাইটোপ্লাজমে দানার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি অনুসারে শ্বেত রক্তকণিকাকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ

  • অ্যাগ্রানুলোসাইট বা দানাবিহীন
  • গ্রানুলোসাইট বা দানাযুক্ত

অ্যাগ্রানুলোসাইট বা দানাবিহীন শ্বেতকণিকা দু রকমের। যথাঃ

  • লিম্ফোসাইট
  • মনোসাইট

গ্রানুলোসাইট বা দানাযুক্ত শ্বেতকণিকা গুলো নিউক্লিয়াসের আকৃতির ভিত্তিতে তিন প্রকার।যথাঃ

  • নিউট্রোফিল
  • ইওসিনোফিল
  • বেসোফিল

শ্বেত রক্তকণিকার কাজ

  • কিছু শ্বেত রক্ত কণিকা ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় দেহকে জীবাণুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করে।
  • এটি এন্টিবডি এন্টিজেন উৎপাদনের মাধ্যমে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে
  • নিউট্রোফিল শ্বেত রক্তকণিকা ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় জীবাণু ভক্ষণ করে।
  • বেসোফিল শ্বেত রক্ত কণিকা হেপারিন নিঃসৃত করে রক্তকে রক্তবাহিকায় জমাট বাঁধতে দেয় না ইত্যাদি।

অনুচক্রিকা

অনুচক্রিকাকে ইংরেজিতে Platelet বলে। এগুলো গোলাকার, ডিম্বাকার অথবা রড আকারের হতে পারে। এয়ার সংখ্যা সেতো রক্তকণিকার চেয়ে কিছু বেশি কিন্তু লোহিত রক্ত কণিকার চেয়ে কম। এর গড় আয়ু ৫-১০ দিন। মানব দেহে প্রতি ঘনমিলিমিটার রক্তে অনুচক্রিকার সংখ্যা প্রায় আড়ায় লক্ষ। অসুস্থ দেহে এদের সংখ্যা আরও বেশি। রক্তে ঠিকমতো অনুচক্রিকা না থাকলে রক্তপাত সহজে বন্ধ হয় না। ফলে অনেক সময় রোগীর প্রাণ নাশের আশঙ্কা থাকে।

অনুচক্রিকার কাজ

  • এর প্রধান কাজ হলো রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করা
  • দেহের রক্তক্ষরণ বন্ধ করে
  • রক্তনালীর ক্ষতিগ্রস্ত অ্যান্ডোথেলিয়াল আবরণ নতুন করে পুনরায় গঠন করে
  • লেডিস সেরোটোনিন নামক রাসায়নিক পদার্থ উৎপন্ন করে, যা রক্তনালির সংকোচন ঘটিয়ে রক্তপাত হ্রাস করে ইত্যাদি।

রক্তের কাজ

দের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে রক্ত। এটি নানাবিধ কাজ করে। যেমন –

  • অক্সিজেন পরিবহন
  • কার্বন-ডাই-অক্সাইড অপসারণ
  • খাদ্য পরিবহন
  • তাপের সমতা রক্ষা
  • বজ্র পদার্থ নিষ্কাশন
  • হরমোন পরিবহন
  • রোগ প্রতিরোধ
  • রক্ত জমাট বাঁধা ইত্যাদি।

তাহলে রক্ত কি, রক্ত কাকে বলে এবং এর প্রকার ও কাজ নিয়ে লেখা এখানেই শেষ করছি। আশা করছে রক্ত কি এবং রক্তের প্রকারভেদ ও কাজ সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারনা দিতে পেরেছি।আর আর্টিকেলটি পড়ে ভালো লাগলে অবশ্যই বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন।

Similar Posts