অর্থনীতিতে ‘দুষ্প্রাপ্যতা’ এবং ‘নির্বাচন’ কি?
অর্থনীতিতে ‘দুষ্প্রাপ্যতা’ এবং ‘নির্বাচন’ কি? (What is the scarcity and choice in economics?)
অর্থনীতিতে ‘দুষ্প্রাপ্যতা’ (Scarcity) এবং ‘নির্বাচন’ (Choice)-এ ধারণা দুটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের সকল অর্থনৈতিক সমস্যার মূলে রয়েছে সম্পদের ‘স্বল্পতা’ বা ‘দুষ্প্রাপ্যতা’। আবার, সীমিত সম্পদ দিয়ে অসীম অভাব পূরণ করতে গিয়ে মানুষকে বিভিন্ন অভাবের মধ্যে ‘বাছাই’ বা ‘নির্বাচন’ করতে হয়। তাই ‘দুষ্প্রাপ্যতা’ ও ‘নির্বাচন’ হলো অর্থনীতির মূল আলোচ্য বিষয়। অধিকাংশ অর্থনীতিবিদ এর মতে, সম্পদের ‘দুষ্প্রাপ্যতা’ বা ‘স্বল্পতা’ এবং বিভিন্ন অভাবের মধ্যের ‘বাছাই’ বা ‘নির্বাচনের’ সমস্যা থেকেই সমাজে অর্থনৈতিক সমস্যার উদ্ভব হয়।
দুষ্প্রাপ্যতা কি? (What is Scarcity in Bengali/Bangla?)
অর্থনীতিতে ‘দুষ্প্রাপ্যতা’ বলতে সম্পদের স্বল্পতা বা অপ্রাচুর্যকে বুঝায়। মানুষের অভাব অসীম। দৈনন্দিন জীবনে মানুষ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসাসহ অগণিত সমস্যার সম্মুখীন হয়। এ সব অভাব পূরণের জন্য প্রয়োজন হলো পর্যাপ্ত সম্পদ। কিন্তু মানুষের প্রয়োজনের তুলনায় সম্পদ খুবই সীমিত। এই সীমিত সম্পদ দিয়ে মানুষের পক্ষে সকল অভাব পূরণ করা সম্ভব হয় না। তাই স্বল্পতার সমস্যা দেখা দেয়। অর্থনীতিতে ‘দুষ্প্রাপ্যতা’ বলতে সম্পদের স্বল্পতা বা অভাব পূরণের উপকরণের সীমাবদ্ধতাকেই বুঝানো হয়েছে।
আধুনিক অর্থনীতিবিদগণ অর্থনীতির আলোচনায় সম্পদের স্বল্পতা বা দুষ্প্রাপ্যতার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
অধ্যাপক এল. রবিনস্ তাঁর প্রদত্ত অর্থনীতির সংজ্ঞায় সম্পদের স্বল্পতা বা দুষ্প্রাপ্যতাকেই অর্থনীতির মূল সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। রবিনস্ বলেন , “অর্থনীতি এমন একটি বিজ্ঞান যা অসীম অভাব এবং বিকল্প ব্যবহারযোগ্য দুষ্প্রাপ্য সম্পদের মধ্যে সমন্বয় সাধন সংক্রান্ত মানুষের আচরণ বিশ্লেষণ করে।”
অধ্যাপক আর. জি. লিপসী বলেন, “দুষ্প্রাপ্যতার সমস্যা হচ্ছে মূল সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি সমস্যা যা অর্থনীতির অধিকাংশ বৈশিষ্ট্যের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে।” (“One of the basic problems encountered in most aspects of economics is the problem of scarcity”.– R. G. Lipsey)।
অর্থনীতিবিদ স্টোনিয়ার এবং হেগ বলেন, “অর্থনীতি মূলত স্বল্পতা এবং স্বল্পতার কারণে উদ্ভূত সমস্যা সংক্রান্ত বিদ্যা”। (“Economics is fundamentally a science of scarcity and of the problems to which scarcity gives rise.”— W. C. Stonier and D. C. Hague)।
সংক্ষেপে বলা যায়, সম্পদের স্বল্পতা বা দুষ্প্রাপ্যতা থেকেই মানুষের সকল অর্থনৈতিক সমস্যার উৎপত্তি।
নির্বাচন কি? (What is Choice in Bengali/Bangla?)
মানবজীবনের অন্যতম মৌলিক সমস্যা হলো ‘বাছাই’ বা ‘নির্বাচন’। মানুষের অসীম অভাব এবং সম্পদের দুষ্প্রাপ্যতা থেকেই নির্বাচনজনিত সমস্যার উদ্ভব।
মানুষের অভাব যেমন অসীম তেমনি সম্পদও যদি অসীম হতো তাহলে ‘বাছাই ’ বা ‘নির্বাচন’-এর কোনো প্রশ্ন দেখা দিত না। কিন্তু মানুষের অভাব অসীম হলেও সম্পদের পরিমাণ সীমিত। অসীম অভাব ও সীমিত সম্পদের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্যই মানুষকে ‘বাছাই’ বা ‘নির্বাচন’ করতে হয়।
অধ্যাপক রবিনসের মতে, মানুষের অভাব পূরণের উপকরণ বা সম্পদ সীমিত হলেও তা বিকল্প ব্যবহারযোগ্য। অর্থাৎ একটি উপকরণ একাধিক দ্রব্য উৎপাদনে ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে কোনো উপকরণকে যে কোনো একটি উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হলে তা একই সাথে অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যায় না। যেমন— একখণ্ড জমিতে ধান অথবা পাট উৎপাদন করা যায়। তবে একই সাথে ঐ জমিতে ধান এবং পাট উৎপাদন করা যায় না। সীমিত সম্পদ দিয়ে মানুষের সকল অভাব একই সাথে পূরণ করা সম্ভব হয় না বলেই বাছাই বা নির্বাচনের প্রশ্ন দেখা দেয়।
অর্থনীতিবিদ বেনহাম যথার্থই বলেন, ‘মানুষ বাছাই করতে বাধ্য হয় বলেই অর্থনৈতিক সমস্যা দেখা দেয়’। (‘Economic Problems arise because people are compelled to choose —Benham’)।
সুতরাং দুষ্প্রাপ্য সম্পদ দ্বারা কোন কোন গুরুত্বপূর্ণ অভাবগুলো আগে পূরণ করা হবে তা নির্ধারণ করা বা চিহ্নিত করাকেই ‘নির্বাচন’ (Choice) বলা হয়। বিভিন্ন অভাবের মধ্যে সঠিক নির্বাচন এর মধ্যেই অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের মূলমন্ত্র নিহিত রয়েছে।
সংক্ষেপে বলা যায়, দুষ্প্রাপ্য সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং অসীম অভাব ও সীমিত সম্পদের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য অর্থনীতিতে ‘পছন্দ’ বা ‘ নির্বাচন’ এর ধারণাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।