পাল ও সেন যুগের বাংলার সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষার পরিচয় দাও।

পাল ও সেন যুগে বাঙালির জীবনযাত্রা সম্পর্কে বিস্তৃতভাবে জানবার কোনো উপায় নেই। প্রাচীন লিপি, শিল্প নিদর্শন ও বৈদেশিক ভ্রমণকারীদের বিবরণ থেকে যে তথ্য জানা যায় তার ভিত্তিতে পাল ও সেন যুগে বাঙালির জীবনযাত্রা সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা করা যায়।

বাঙালির সমাজ জীবনঃ বাংলাদেশে ইসলামের আবির্ভাবের অনেক আগেই বাংলার সমাজ-ব্যবস্থা ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ ইত্যাদি বর্ণে বিভক্ত হয়ে যায়। তাদের মধ্যে কৌলীন্য প্রথা চালু হয়। সমাজ বর্ণবিভক্ত হলে পরস্পরের সঙ্গে স্বাভাবিক মিলনের পথ বন্ধ হয়ে যায় ও সমাজের দেওয়া-নেওয়ার মধ্যে অনেক আড়ষ্টতা আসে। এই নিয়মেই সমাজে অসবর্ণ বিবাহ, বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধ হয়েছিল। কুলীন হওয়ার ফলে কিছু মানুষের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। ফলে সমাজে ভেদাভেদ দেখা দেয়। সমাজে তখন সতীদাহ প্রথা চালু ছিল। বিবাহ, অন্নপ্রাশন, দান, প্রায়শ্চিত্ত ইত্যাদি নানারকম দেশাচার ও কুলাচার নিয়ে মানুষ ব্যস্ত থাকত। বর্ণ ব্যবস্থার উদ্ভবের ফলে জাতিভেদ প্রথার কঠোরতা বৃদ্ধি পায়। বাংলার অধিকাংশ মানুষ তখন গ্রামে থাকত। তবে সমৃদ্ধিশালী শহরের অভাব ছিল না। নগরবাসীরা গ্রামবাসীদের তুলনায় বেশি মাত্রায় উদ্ধৃঙ্খল ও বিলাসী ছিল। কৃষিকার্যই ছিল বাঙালির প্রধান উপজীবিকা। শহরাঞ্চলের মানুষ ব্যাবসা-বাণিজ্যকে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করত। বাংলার পণ্যসামগ্রী এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হত।

সংস্কৃতিঃ পাল ও সেন যুগে প্রধান খাদ্য ছিল ভাত, ডাল, তরকারি, মাছ, মাংস, ঘি, দুধ ইত্যাদি। উৎসব অনুষ্ঠান উপলক্ষে পিঠাপুলি খাবার প্রথা ছিল। পুরুষরা ধুতি, চাদর এবং মহিলারা শাড়ি, ব্লাউজ পরতেন। এছাড়া তারা শাখা, সিন্দুর ও সােনা-রুপাের গহনা পরতে ভালােবাসতেন।

পাল ও সেন যুগে বাংলার সংস্কৃতির অন্যান্য দিকে বিস্ময়কর উন্নতি ঘটেছিল। ভাস্কর্য, স্থাপত্য, কারুশিল্প ও চিত্রাঙ্কন বিদ্যায় বাঙালি যথেষ্ট পারদর্শিতা লাভ করেছিল। বাংলার ধর্ম ও সংস্কৃতি তখন পৃথিবীর বহুদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। তার নিদর্শন ভারত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জে আবিষ্কৃত হয়েছে। শূলপাণি, বীটপাল ও ধীমান ছিলেন এযুগের শ্রেষ্ঠ ভাস্কর ও ধাতুমূর্তি শিল্পী।

আর্থিক অবস্থাঃ পাল ও সেন যুগের অর্থনীতিও এক বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। সামন্ত প্রথা প্রচলিত হওয়ার সাথে সাথে এযুগে জমিদারি প্রথার প্রচলন হয়। পাল ও সেন রাজারা রাজকর্মচারীদের নগদ বেতনের পরিবর্তে জায়গির দিতেন। ফলে জমিদারি জায়গির প্রথা দ্রুত প্রসার লাভ করে। অনেক সময় জায়গিরদারগণ শক্তিশালী হয়ে রাজার বিরুদ্ধে দাঁড়াতেন।

কৃষিই ছিল মানুষের সাধারণ উপজীবিকা। কিন্তু কৃষকদের অবস্থা তেমন স্বচ্ছল ছিল না। কৃষকরা চাষবাসের সঙ্গে সঙ্গে কাপড় বুনে, মাটির ও লােহার জিনিস তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এ থেকেই সমাজে তাতি, কুমাের, কামার, ছুতাের প্রভৃতি নানা শ্রেণির বৃত্তিভােগী মানুষের উদ্ভব হয়। পাল ও সেন যুগের এই চিত্র অর্থনীতি ইউরােপের ম্যানরে বসবাসকারী কৃষক সম্প্রদায়ের জীবিকার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সে সময় বাংলার মসলিন ও তাঁতের কাপড়ের বিশ্বজোড়া সমাদর ছিল। এগুলি বহু দূরদেশে রপ্তানি হত। বাংলার তাঁতশিল্প সপ্তগ্রামে ছিল।

শিক্ষাচর্চাঃ পাল ও সেন যুগে বাঙালির মধ্যে বিদ্যাচর্চার যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। হাজার বছর পরে বর্তমানেও বাঙালির সেই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। পাল যুগে বাংলার শিক্ষাকেন্দ্র ছিল বৌদ্ধবিহার বা মঠগুলাে। পাল রাজাদের উদ্যোগে অনেক বৌদ্ধবিহার নির্মিত হয়। এই বিহারগুলােতে বৌদ্ধ ধর্মশালা ব্যতীত জ্ঞানবিজ্ঞান ও সাহিত্যচর্চা হত। এক কথায় বলতে গেলে, সেই আমলে বাংলার বৌদ্ধবিহারগুলি ভারতের শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত হয়। এই সূত্রে ওদন্তপুর এবং বিক্রমশীলা মহাবিহার দুটির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। বিহার প্রদেশে অবস্থিত ওদন্তপুরের বৌদ্ধবিহারটি নালন্দা বা অন্যান্য বৌদ্ধবিহারের মতােই প্রসিদ্ধ ছিল। পালরাজ ধর্মপাল যে পঞ্চাশটি শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন ওদন্তপুর ওইগুলির অন্যতম। বিখ্যাত পণ্ডিত শীলরক্ষিত এই বিহারের আচার্য ছিলেন। দ্বাদশ শতাব্দীতে বহিঃশত্রুর আক্রমণে পূর্ব ভারতের অন্যান্য বিহারগুলির সঙ্গে ওদন্তপুর বিহার ধ্বংস হয়ে যায়।

বর্তমান ভাগলপুরের কাছে পাথরঘাট পর্বতের উপর বিক্রমশীলা বৌদ্ধবিহার অবস্থিত। এই বিহারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ধর্মপাল। এই বিহারটিতে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষাদান করা হত। কমপক্ষে একশ আটজন পণ্ডিত বিক্রমশীলা বিহারের অধ্যাপনার কাজ করতেন। এই বিহারের খ্যাতি দেশবিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এই মঠে অধ্যায়নের জন্য সুদূর তিব্বত থেকে শিক্ষার্থীরা এসে সমবেত হতেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *