ফিতরা কি? ফিতরা দেওয়ার নিয়ম কি?

ফিতরা কি?
রমজান মাস শেষে পবিত্র ঈদুল ফিতর উদ্‌যাপন উপলক্ষে মাথাপিছু যে নির্দিষ্ট পরিমাণ আর্থিক সাহায্য গরিব-মিসকিনদের সাদকা করা হয়, একে ‘সাদাকাতুল ফিতর’ বলে। রোজা পালনে বা সিয়াম সাধনায় অত্যন্ত সতর্কতা সত্ত্বেও যেসব ছোটখাটো ভুলভ্রান্তি বা ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়, তার প্রতিকার ও প্রতিবিধান বা ক্ষতিপূরণের জন্য রমজান মাসের শেষে সাদাকাতুল ফিতরকে ওয়াজিব করে দেওয়া হয়েছে। ধনীদের পাশাপাশি গরিবেরাও যেন ঈদের আনন্দে শরিক হতে পারে, সে জন্য ইসলামি শরিয়তে ঈদুল ফিতরে ধনীদের ওপর ‘সাদাকাতুল ফিতর’ ওয়াজিব করা হয়েছে।

ফিতরা নির্ধারণের রহস্য
ইসলাম মানবতাবাদী ধর্ম। সম্প্রীতি ও সহমর্মিতার শিক্ষা প্রদান করে। ধনী-গরিব সকলে যেন ঈদ উৎসবে সমানভাবে আনন্দ উপভোগ করতে পারে সেজন্য এই সাদাকাতুল ফিতরা নির্ধারণ করা হয়েছে। ফিতরা মূলত রোজার জাকাত। জাকাত যেমন মালকে পবিত্র করে, ঠিক তেমনি ফিতরাও রোজাকে পবিত্র করে।

এ প্রসঙ্গে ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) সদকায়ে ফিতর নির্ধারণ করেছেন রোজাকে অনর্থক কথা ও অশ্লীল ব্যবহার হতে পবিত্র করার এবং গরিবের মুখে অন্ন দেওয়ার জন্য। (সূত্র : মেশকাত: আবু দাউদ)

ওয়াকি ইবনুল জাররাহরা বলেন, সিজদায়ে সাহু যেমন নামাজের ক্ষতিপূরণ, তেমনি সাদাকাতুল ফিতর রোজার ক্ষতিপূরণ।

ফিতরা কার উপর ওয়াজিব
নিসাব পরিমাণ তথা সম্পদশালী ব্যক্তির নিজের পক্ষ থেকে, নাবালক সন্তানদের পক্ষ থেকে সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব হয়। পরিবারস্থ স্ত্রী, কন্যা ও রোজগার বিহীন সাবালক সন্তানের পক্ষ থেকে সাদাকাতুল ফিতর প্রদান করা উত্তম। তবে ওয়াজিব নয়। (সূত্র: হিদায়া, আলমগীরী-১)

ফিতরার পরিমাণ
এর পরিমাণ ছোট-বড়, নারী-পুরুষ প্রত্যেকের পক্ষ থেকে আধা সা’ গম-আটা বা এক সা’ যব, কিশমিশ, খেজুর, চাল, বাজরা, ভুট্টা ইত্যাদি বা তার মূল্য। (সূত্র: শামি-২)

নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক বলতে জীবিকা নির্বাহের আবশ্যকীয় উপকরণ যথা আবাস গৃহ, পরিধেয় বস্ত্র, খাদ্য দ্রব্য, ঘরের ব্যবহার্য সরঞ্জামাদি ব্যতীত সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ (৮৮ গ্রাম সোনা) বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা (৬১৩ গ্রাম) অথবা সম পরিমাণ নগদ অর্থ বা সম্পদ থাকাকে বোঝায়। ( সূত্র: আলমগীরী-১, শামি-২)

বর্তমান হিসাব মতে, এক সা মানে (৩.৩০০ কেজি) তিন কেজি ৩০০ গ্রাম এবং আধা সা মানে (১.৬৫০ গ্রাম) এক কেজি ৬৫০ গ্রাম। জাকাতের অনুরূপ সাদাকাতুল ফিতরের ক্ষেত্রে পুরো বছর নিসাবের মালিক থাকা আবশ্যক নয়। কেবল ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদেকের পূর্বে মুহূর্তে নিসাব পরিমাণ মাল থাকা বিবেচ্য।

সাদাকাতুল ফিতরের মাসায়েল

পবিত্র মাহে রমজানে সাদাকায়ে ফিতর একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত বা আমল। নিম্নে এর কিছু বিধি-বিধান উল্লেখ করা হলো-
(১) যদি কেহ ঈদের আগেই ফিতরা প্রদান করে, তা জায়েজ, এমনকি উত্তম ও বটে।
(২) একজনের ফিতরা একজনকে বা কয়েক জনকে এবং কয়েক জনের ফিতরা একজনকেও দেওয়া জায়েজ। (ইমদাদুল-২-মাহামুদিয়া-৩)
(৩) রোজা ও ফিতরা দুটি পৃথক ইবাদত, তাই যদি কোনো কারণে রোজা না রাখলেও ফিতরা দিতে হয়। (আলমগীরী-১)
(৪) ঈদের নামাজের আগে আদায় করতে না পারলে ফিতরা মাফ হবে না। পরে তা আদায় করা ওয়াজিব তবে ঈদের ২-৩ দিন পূর্বে আদায় করা উত্তম, যাতে গরিব ফিতরার টাকা দিয়ে কেনাকাটা করে ঈদের আনন্দে শরীক হতে পারে।
(৫) যব, গম, আটা, খেজুর, কিশমিশ ইত্যাদির বাজার মূল্যের সমপরিমাণ নগদ অর্থ যা বর্তমান বাজারে সর্বনিম্ন ৭০ টাকা ফিতরা হিসেবে আদায় করা যায়।

(৬) সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব হওয়ার সময় হল ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদিক হওয়ার পর। সুবহে সাদিকের পূর্বে কেউ মারা গেলে তার উপর ফিতরা ওয়াজিব হবে না। সুবহে সাদিকের পর কোনো সন্তান জন্ম গ্রহণ করলে কিংবা কেউ মুসলমান হলে তার উপর ফিতরা ওয়াজিব।
(৭) মালদার ব্যক্তি নিজে এবং নিজের নাবালিগ সন্তানের পক্ষ থেকে সাদাকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব।
(৮) নিজ পরিবারভুক্ত নয় এমন লোকের পক্ষ থেকে তার অনুমতি ছাড়া ফিতরা দিলে আদায় হবে না।
(৯) যারা তাদের খাদেম বা চাকর বাকরের পৃষ্ঠ-পোষকতা ও ভরণ-পোষণ করে তারা তাদের পক্ষ থেকে সাদকা দিয়ে দিবে।
(১০) স্ত্রী লোক যদি সচ্ছল হয় তাহলে শুধু সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব। তার নিজের ব্যতীত স্বামী, সন্তান বা মা-বাবার পক্ষ থেকে দেওয়া তার ওয়াজিব নয়।
(১১) গরিব-মিসকিন এক কথায় যার নিকট নিসাব পরিমাণ সম্পদ নেই এমন ব্যক্তিকে সদকায়ে ফিতর দেওয়া জায়েজ আছে।
পরিশেষে, মহান আল্লাহর তায়ালার কাছে এই কামনা করি, পবিত্র মাহে রমজানে নেক আমল হিসেবে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করার তাওফিক দান করুক। আমিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *