পাবনায় প্রায় দেড়শ বছর পর রেলসেতুর সংস্কার শুরু!
১৪২ বছর আগের কথা। ব্রিটিশ আমলে কলকাতা থেকে সাঁড়াঘাট হয়ে (বর্তমান ঈশ্বরদী জংশন) দার্জিলিং মেইল চলাচল করত। ওই সময় ঈশ্বরদী-চিলাহাটি রুটে ২৬৪ ফুট লম্বা রেলসেতু তৈরি করা হয়েছিল।
রেলসেতুটির গার্ডারের বেডব্লকে ফাটল ধরার কারনে ঝুঁকি নিয়ে আন্তঃনগর যাত্রীবাহী ট্রেনগুলো চলাচল করছিল। বর্তমানে ওই রেলসেতুর ওপর দিয়ে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ের আওতায় (ঈশ্বরদী-রাজশাহী-চিলাহাটি) রেলরুটে ২২ জোড়া যাত্রীবাহী আন্তঃনগর ও মালবাহী ট্রেন চলাচল করে।
১ কোটি ১৮ লাখ টাকা ব্যয়ে পুরোনো গার্ডার ব্রিজের সংস্কারের কাজ করার উদ্যোগ নিয়েছে পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে প্রকৌশলী দপ্তর।
রবিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) দিনগত রাত ১২ টায় ঈশ্বরদী-নাটোর রেলরুটের ঈশ্বরদী রেলওয়ে স্টেশন থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে নাটোরের লালপুরের পাটিকাবাড়ি ২১৩ নাম্বার রেলব্রিজ দিয়ে ট্রেন চলাচলের উপযোগী করতে পরীক্ষামুলকভাবে ভারী ইঞ্জিন চালিয়ে ঈশ্বরদী-রাজশাহী-নাটোর রেলরুট সচল করা হয়।
সিসিক্রিপ দিয়ে বিকল্প অস্থায়ী রেললাইন তৈরি করার পর (ডাউন) লাইন দিয়ে খুলনা থেকে ছেড়ে আসা যাত্রীবাহী আন্তঃনগর সাগরদাঁড়ি ট্রেন পারাপার করা হয়। সারাদিনে (আপ) লাইনে উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে চলাচলকারী সব যাত্রীবাহী আন্তঃনগর এবং মালবাহী ট্রেন চলাচল করানো হয়।
রবিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) সকাল ৮ টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ছয়টি পায়ার থেকে ৬টি গার্ডার সরিয়ে দুই শতাধিক শ্রমিক অক্লান্ত পরিশ্রম করে সিসিক্রিপ দিয়ে অস্থায়ীভাবে রেল চলাচলের ব্যবস্থা করেন। এছাড়া মঙ্গলবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) অপর রেললাইনের কাজ চলবে। পরিবর্তী সময় করে আবার পায়ারগুলোর বেডব্লক ভেঙ্গে নতুনভাবে সংস্কার কাজ শুরু হবে।
এদিকে রবিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) রাত ১২ টায় সংস্কার কাজের স্থান পরিদর্শন করেছেন, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহা-ব্যবস্থাপক (জিএম) অসীম কুমার তালুকদার, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী, মনিরুল ইসলাম ফিরোজী,অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আসাদুল হক।
এছাড়া অস্থায়ী রেললাইন নির্মিত কাজের সময় উপস্থিত ছিলেন, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আসাদুল হক, পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে প্রকৌশলী-২ আব্দুর রহিম,ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী (কার্য) তৌহিদুল ইসলাম সুমন, ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী (পথ) বি,এম, বাকিয়াতউল্লাহ বাকি, ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী (ব্রিজ) হাসান আলী, উপ-সহকারী প্রকৌশলী (কার্য) আতিক উর রহমান,পদ্মা ট্রেডিং এর ঠিকাদার রফিকুল ইসলাম সুলতান প্রমুখ।
এর আগে সরেজমিন দেখা যায়, ঈশ্বরদী স্টেশন থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে পাটিকাবাড়ি সেতুটি ১৪২ বছরের ব্রিটিশ আমলে নির্মিত ব্রিজ। ব্রিজটি ২৬৪ ফিট লম্বা, ৬ টি পিলারে দাঁড়িয়ে আছে। ঝুঁকিপূর্ণ পুরনো রেলব্রিজ দিয়ে সব ট্রেন পারাপার হবার আগেই রীতিমত লাল সিগন্যাল দেখে বিভিন্ন রুটের আন্তঃনগর ট্রেন থেমে যাচ্ছে। পরিবর্তীতে ট্রেনের চালক ওটিপি স্বাক্ষর করার পর যাত্রীদের নিয়ে আন্তঃনগর ট্রেন ঝুঁকি নিয়ে স্লো গতিতে পারপার করতে দেখা যায়। সেতুটিতে ছয়টি পিলার।
পিলারের ওপরে লোহার গার্ডারের নিচে আরসিসি বেডব্লকগুলো খণ্ড খন্ডভাবে বড় বড় ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে। রোববার সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সিসিক্রিপ ১০ ইঞ্চি উপর দিয়ে বিকল্প রেললাইন তৈরি করা হয়েছে। ব্রিজের পিলারের সংস্কার কাজ যেন সহজ হয়। একটি রেললাইন দিয়ে সারাদিনে ২২ জোড়া ট্রেন পারাপার করা হয়।
রেলসেতুর পোর্টার রমজান আলী জানান, সব যাত্রীবাহী ট্রেনগুলো ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হতো, বেডব্লক ফাটল ধরার কারণেই যাত্রীবাহী ট্রেন পারাপার হওয়ার সময় রেললাইনটি কেঁপে উঠতো। বর্তমানে আমরা ওটিপিতে চালকদের স্বাক্ষর করিয়ে ৪৪টি আন্তঃনগর এবং মেইল লোকাল ও মালবাহী ট্রেন পারাপার করা হচ্ছে।
পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী তৌহিদুল ইসলাম সুমন জানান, ২৬৪ ফুট লম্বা সেতুর গার্ডারের নিচে সেতুর পিলারের বেডব্লকে ফাঁটল দেখা দেওয়ার কারণে বেডব্লকে নিচের সেতুর পিলার ভেঙ্গে নতুন করে পুনঃনির্মাণ করা হবে।
তিনি আরও জানান, বেডব্লক পুরোটায় খণ্ড খণ্ড ভাবে ফাঁটল ধরেছে। যেকোনো সময়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে, সে কারণে পুনর্নির্মাণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ের প্রকৌশলী-২ আব্দুর রহিম বাংলানিউজকে জানান, রেলবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশক্রমে রেল মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ঝুঁকিপূর্ণ সেতুগুলো দ্রুত সংস্কার করতে হবে।
প্রকৌশলী-২, আব্দুর রহিম আরও জানান, ব্রিটিশ আমলে নির্মিত ব্রিজ দিয়ে অতিরিক্ত ট্রেন চলাচল করার কারণে আরসিসি বেডব্লক ফাটল সৃষ্টি হয়েছিল। ব্রিজের সামনে এসে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম গতিতে ব্রিজে ট্রেন চলতো। ব্রিজটিতে ২৫ টন এক্সেল লোড নেওয়ার মত অবস্থা ছিল না। সিসিক্রিপ দিয়ে অস্থায়ী ব্যবস্থাপনায় রেল চলাচল স্বাভাবিক রেখে সংস্কার কাজটি শেষ করা হবে। ৪৫ দিন প্রকল্পে ব্রিজটি সংস্কার করা হলে এই ব্রিজ দিয়ে ৮৫ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলবে।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে রাজশাহীর প্রধান প্রকৌশলী মনিরুল ইসলাম ফিরোজী জানান, পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ের আওতায় ব্রিটিশ আমলে নির্মিত ঝুঁকিপূর্ণ ব্রিজগুলো আমরা পরিদর্শন করেছি। ঝুঁকিপূর্ণ ব্রিজগুলো সংস্কার কাজ চলমান রয়েছে। পর্যায়ক্রমে সব ব্রিজগুলো সংস্কার করা হবে।
রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, ১৮৬২ সালে ট্রেন চালু হওয়ার পরে আসাম, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়িতে ট্রেন চলাচল করতো। সে সময় দার্জিলিং মেইল নামে একটি ট্রেন চলতো। ১৮৭৩ সালে বিহারে ও পশ্চিম বাংলার কয়েকটি জেলাতে দুর্ভিক্ষ দেখা যায়। দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করতে ১৮৭৪ সালে শুরু করে ১৮৭৮ সাল ইংল্যান্ডে নর্দান বেঙ্গল স্টেট নামে রেল কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরবর্তীসময় ৩৩৬ কিলোমিটার মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণ হয় দুর্ভিক্ষ অঞ্চলে সহজে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানোর জন্য ব্রিটিশদের ব্যবসা এবং বানিজ্যিক কারণে। সে সময় কোলকাতা আসাম, শিলিগুড়িতে যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করা হয়। তখন চা, পাট,তামাকের জন্য বিখ্যাত ছিল।
১৮৭৪ সালে পদ্মা নদীর সাঁড়াঘাট (বর্তমানে ঈশ্বরদী) থেকে আবদুলপুর জং-সান্তাহার জং পার্বতীপুর জং- সৈয়দপুর এবং নীলফামারীর চিলাহাটি হয়ে শিলিগুড়ি ট্রেন চলতো। ১৮৮০ সালের দিকে ১৯২৬ সালে নর্দান বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ে কোম্পানি সাঁড়াঘাট থেকে শিলিগুড়ি রেললাইন ব্রডগেজে রূপান্তরিত করা হয়। ওই সময় ঈশ্বরদী-চিলাহাটি রেলরুটে রেলসেতুটি নির্মিত হয়।